Hot Posts

6/recent/ticker-posts

৩৯ দিন পর বুকে বুলেট নিয়ে হার মানলেন শোহান, পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ

 

শোহান শাহ । ছবি: সংগৃহীত


শোহান শাহ ছোট বয়সেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। মা-বাবা, স্ত্রী, এবং স্কুলে পড়া ছোট ভাইয়ের সব খরচই আসত তার একার বেতন থেকে। পরিবারের একমাত্র ভরসা শোহান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। বুকে বুলেট নিয়ে ৩৯ দিন লড়াই করার পর শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি। এখন তার পরিবারের সদস্যরা চরম বিপদের মধ্যে আছেন।


শোহান শাহের (২৯) বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ রোড এলাকায়। অর্থ সাশ্রয়ের জন্য শোহান তার স্ত্রীকে মা-বাবার কাছে রেখে ঢাকায় মেসে থাকতেন এবং চাকরি করতেন। গ্রামের বাড়িতে নতুন একটি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছিল, যেখানে শম্পা বেগমের সঙ্গে সুখের সংসার পাতার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। গত ১৯ জুলাই ঢাকার রামপুরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন শোহান, এবং ৩৯ দিন পর ২৭ আগস্ট ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার মরদেহ ময়নাতদন্তের পর শ্রীপুরে দাফন করা হয়।


বৃহস্পতিবার বিকেলে শ্রীপুরে শোহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার স্ত্রী শম্পা বেগমের কান্না থামছে না। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি বারবার বলছেন, শোহান ছাড়া এখন তিনি কীভাবে বাঁচবেন।


শম্পা বেগম বলেন, ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর তাদের বিয়ে হয়েছিল। প্রথম তিন বছর তারা ঢাকায় একসঙ্গে সংসার পেতেছিলেন। পরে অর্থের অভাবে শম্পাকে গ্রামে রেখে শোহান ঢাকায় চাকরি করতেন। শম্পা বলেন, "আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। অর্থের কারণে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারিনি। শোহান আমাকে বলেছিল, 'শম্পা, আমি আর তুমি এই ঘরে থাকব।'"


গত মঙ্গলবার ঢাকার সিএমএইচে স্বামীর সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হয়েছিল শম্পার। তখন শোহান তাকে বলেছিল, 'তুমি কেঁদো না। আমার কিছুই হবে না।' কিন্তু সেই কথা রাখেননি শোহান। অস্ত্রোপচারের পরও রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায়নি এবং ১৮ ব্যাগ রক্ত দিয়েও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শম্পা বলেন, "অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না। শোহান সব সময় আমার পাশে থেকেছে। আল্লাহ আমাকে সন্তানও দেননি। এখন আমি কীভাবে বাঁচব?"


শ্রীপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে প্রায় ১০ বছর আগে শোহান সংসারের দায়িত্ব নিতে চাকরিতে যোগ দেন। শেষমেশ ঢাকার রামপুরা এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। তার বাবা শাহ সেকেন্দার প্রায় এক দশক আগে নিজের ব্যবসা গুটিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। তার ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।


শাহ সেকেন্দার বলেন, "আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই কর্মঠ আর দায়িত্বশীল ছিল। বিয়ের পর একদিনও বসে থাকেনি। চাকরি না থাকলে বাড়িতে এসে রাজমিস্ত্রির কাজও করেছে। সেদিন সকালে বিকাশে আমাকে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে বলল, এই টাকা তুলে চলে আসেন।"


শোহানের মা সুফিয়া বেগমও ছেলে হারানোর শোকে ভেঙে পড়েছেন। তিনি বলেন, "আমার ছেলে সব বুঝত, কোনো কথা লুকাতে পারতাম না। টাকা পাঠিয়ে বলত, ‘মা, তুমি চিন্তা করো না, আমি আছি।’ এখন এই কথা আমাকে কে বলবে? সবাই আছে, শুধু আমার ছেলে নেই।"

শোহান শাহের এক্স–রে প্রতিবেদন

শোহান শাহ গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে চারটার দিকে রামপুরা সিএনজি পাম্প এলাকায়। তখন তার সঙ্গে দুই সহকর্মী ওলিউল ইসলাম ও নূর হোসেন ছিলেন। সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর শোহানকে প্রথমে বেটার লাইফ হাসপাতালে নেওয়া হয়, সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে তাকে ভর্তি করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয় এবং সেখানে তার ছোট অস্ত্রোপচার করা হয়, তবে গুলি শরীরে থেকেই যায়।


সহকর্মী ওলিউল ইসলাম বলেন, ২২ জুলাই বক্ষব্যাধি হাসপাতালে শোহানকে অক্সিজেন নিতে সহযোগিতা করছিলেন, তখন পুলিশ এসে তাদের লাঠিপেটা করে। এরপর ওলিউল ইসলামকে বনানী থানায় আটক করা হয়। ৪ ঘণ্টা পর তিনি মুক্তি পান।


পরিবারের সদস্যরা জানান, শোহানের উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ভারতে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তারা। কিন্তু নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়। স্থানীয়দের মাধ্যমে তারা জানতে পারেন, শ্রীপুর থানায় করা একটি নাশকতার মামলায় শোহানকে আসামি করা হয়েছে। 


শাহ সেকেন্দার বলেন, "আমার ধারণা, তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরেই ষড়যন্ত্র করে তাকে মামলায় আসামি করা হয়েছে। আমার ছেলেকে গুলি করা থেকে শুরু করে চিকিৎসায় বাধা দেওয়া, সব অপরাধের ন্যায়বিচার চাই আমি।"

Post a Comment

0 Comments